টলিপাড়ার এক নামী অভিনেতার কাছে অপমানিত হওয়া থেকে আজ সফল অভিনেতা, জীবনের অজানা গল্প নিয়ে মুখ খুললেন ভাস্বর চ্যাটার্জী

নিজস্ব প্রতিবেদন: ‌ টেলিভিশন দুনিয়ার এবং চলচ্চিত্র জগতের একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতা হলেন ভাস্বর চ্যাটার্জী। সহজ এবং সাবলীল অভিনয় দ্বারা খুব সহজেই দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন এই অভিনেতা। তবে বহু তারকাদের মতই তার অভিনয়ে জীবনের শুরুটা কিন্তু ঠিক সহজ ছিল না।।

বহু লড়াই করে এই জীবনের একটা জায়গায় আসতে হয়েছে তাকে। সম্প্রতি জোশ টকস নামের একটি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে নিজের জীবন সংগ্রামের বহু দিক তুলে ধরেছেন এই অভিনেতা। আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা তুলে ধরব অভিনেতা ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ের সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ।

সাক্ষাৎকারের শুরুতেই অভিনেতা জানান তার ছোটবেলা থেকেই দুটো জিনিস ভীষণ প্রিয় ছিল। ভাস্বরের কথায়,“আমার স্বপ্ন ছিল আমি ট্রেনের ইঞ্জিন ড্রাইভার হব। আরেকটা স্বপ্ন ছিল আমি অভিনেতা হব। ছোটবেলায় যখন ক্রিকেট, ব্যাট ,ফুটবল এসব সবাই কিনতে থাকে। আমি খুব বিজি ছিলাম আমার ট্রেন নিয়ে। আমি খেলনা মানেই কিনতাম বিভিন্ন ট্রেন অর্থাৎ রেলগাড়ি।

তবে একটা সময়ের পর আমি বুঝলাম আমার পক্ষে ইঞ্জিন ড্রাইভার হওয়া সম্ভব নয়। আমার যে দ্বিতীয় স্বপ্নটা ছিল যেটা এখন আমার জীবনের প্রধান স্বপ্ন, সেটা ছিল অভিনয়। অভিনয় নিয়ে আমার মধ্যে এতটাই অবসেশন ছিল যে ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে যখন স্কুল থেকে ফিরতাম, যখন আমাদের বাংলাতে যুক্তাক্ষর শেখানো হয়নি, তখন রাসবিহারী ক্রসিং এর আশেপাশে বড় বড় বাংলা ছবির ব্যানার লাগানো থাকতো।

একদিকে হয়তো রয়েছে উত্তম কুমারের ওগো বধূ সুন্দরী, অন্যদিকে হয়তো রয়েছে বাঞ্ছারামের বাগানের বড় বড় পোস্টার। আমি উচ্চারণ করতে পারিনি তবে ওই বাঞ্ছারামের বাগান জিনিসটা আমার ভীষণ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। ওটা বাড়ি এসে আমি খাতা হাতে পেন্সিল দিয়ে লিখে ছিলাম। আমার জীবনের প্রথম যুক্তাক্ষর লেখা ছিল বাঞ্ছারামের বাগান। এটা দেখে সবাই খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল যে স্কুলে পড়ানো হয়নি অথচ আমি জানলাম কি করে”!

তিনি আরো জানান যে, “ছোট থেকেই যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করত আমি বড় হয়ে কি হব? আমার সোজাসাপ্টা উত্তর ছিল,অভিনেতা হব। এই ব্যাপারটা নিয়ে যদিও আমি বাবা মায়ের তরফ থেকে কখনো কোন সমস্যার মুখোমুখি হয়নি। তারা সব সময় আমাকেই সাপোর্ট করেছেন। তবে পারিপার্শ্বিক যারা বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন ছিলেন তারা কিন্তু প্রায়ই বলেছেন যে ইঞ্জিনিয়ার বাড়ির ছেলে অভিনেতা হবে?..”

ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “আমি প্রথম জীবনে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করেছি। আমার পক্ষে ভারী ভারী ব্যাগ টেনে ঘুরে আনতে একদম ভালো লাগত না। প্রত্যেকদিনই আমি হাফ ডে কাজ করে নাট্য দলে চলে যেতাম। এই করতে করতে একদিন ক্যামেরার সামনে আসি এবং স্টুডিও যাই। তবে স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার মধ্যে বড়সড়ো পার্থক্য রয়েছে।

কখনো আমাকে হয়তো ফ্লোর থেকে বার করে দিচ্ছে যে তুমি তো পরশুদিন এসেছিলে আবার এখন কি? স্টূডিও আসা মানে কিন্তু তখন বেশ কঠিন ব্যাপার ছিল। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে এখানে আসতে হতো। এই করতে করতেই আমার হাতে একদিন সুযোগ আসলো ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর। তবে যেটা হয় যে নতুনদের বারবার ঠোকর খেতে হয়।

আমার ক্ষেত্রেও সেটার ব্যতিক্রম হয়নি। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, বারুইপুর রাজবাড়িতে শুটিং করছি, দুপুরবেলায় ব্রেক হয়েছে।এই সময় খাওয়া-দাওয়া করছেন সকলে, তখন আমি বললাম আমার খাবারটা একটু দিয়ে যাবেন? তখন উত্তর এলো যে তুমি কে উত্তম কুমার? তোমার খাবার দিয়ে যেতে হবে! নিচে গিয়ে খাও। নিচে গিয়ে দেখলাম বিরাট বিয়ে বাড়ির মতন টেবিল পাতা রয়েছে এবং সমস্ত টেকনিশিয়ান বসে খাচ্ছে।

সেখানেই সবার সঙ্গে আমি খাওয়া শুরু করলাম।। একটা কাজে যাচ্ছি সবার জন্য বরাদ্দ থাকলো গাড়ি তবে আমাকে দেওয়া হলো একটা টেকনিশিয়ান ভ্যান। তখনকার টেকনিশিয়ান ভ্যান মানে কিন্তু ভীষণ ছোট। সেই ভ্যানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যেত না একেবারে নামিয়ে থাকতে হতো। আমি যেহেতু লম্বা তাই দাঁড়ানোর সুযোগই পেতাম না”।

অভিনেতা আরো জানান, “এরপর যখন ধীরে ধীরে আমি অভিনেতা হিসেবে শুরু করলাম এই লোকেদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আমি গাড়ি থেকে নামার পর আমার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে গিয়েছে। আসলে এগুলো নিয়ে মন খারাপ করে কোন লাভ নেই। এগুলো আগেও হতো, এখনো হবে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। তবে হয়তো সত্যি স্ট্রাগল না করলে একটা জায়গায় এসে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

আমি লক্ষ্য করে দেখছি আমার যারা জুনিয়র রয়েছে এখন তারা এই স্ট্রাগল করতে গিয়ে হয়তো হতাশ হয়ে পড়ছে, এমনকি সুইসাইড পর্যন্ত করে ফেলছে। এবার হতাশাটা কিন্তু সম্পূর্ণ নিজের উপর যে আমি হব কি হবো না? আমার কাছেও কিন্তু হতাশ হওয়ার প্রচুর রাস্তা ছিল।

আমি যখন অল্প করে কাজ করছি তখন এমনটা হয়েছে যে, একটা অ্যাওয়ার্ড ফাংশনে গিয়েছি নন্দনে আমাকে প্রথম সারিতেই বসতে দেওয়া হয়েছে,আমার সেখানে নামও রয়েছে.. একজন সিনিয়র অভিনেতা এসে আমাকে বললেন এই যা এখান থেকে ওঠ।

তবে এরপর যখন আমি বোম্বেতে কাজ করে এসে কলকাতায় ফিরলাম তখন আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, আমি মানুষটা একই রইলাম সবকিছুই এক রইলো কিন্তু চারপাশ যেন আচমকাই পরিবর্তন হয়ে গেল।

কলকাতাতে আসলে যারা অভিনয় করে, তাদের উপর কিন্তু বোম্বের স্ট্যাম্প ভীষণ প্রয়োজন। যখন আমার উপরেও ওই স্ট্যাম্প পড়ে গেল তখন আমার অভিনয়, আমার ব্যবহার সবকিছুই কিন্তু খুব ভালো হয়ে গেল। এক সময় যখন আমাকে রিজেক্ট করা হতো যে আমি খুব রোগা, আসলে অভিনয় করতে পারি না এই কথাটা কেউ কখনো বলতে পারেন নি।

কিন্তু নানান রকম ভাবে আমাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হতো। এই বাদ দেওয়াটা কিন্তু আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রচুর কিছু পেয়েছি আমি। আমি প্রচুর লাকি যে ইন্ডাস্ট্রির যে স্বর্ণযুগ,সেই সময়কার বহু মানুষদের সঙ্গে আমি কাজ করতে পেরেছি”। শুধুমাত্র অভিনেতা হিসেবেই নন ব্যক্তিগত জীবনেও ভাস্বর চট্টোপাধ্যায় কিন্তু একজন অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ।

তার চরিত্রের বিভিন্ন ভালো দিকের পরিচয় কম বেশি অনেকেই কিন্তু আপনারা পেয়েছেন। অভিনেতার এই সাক্ষাৎকারটি আপনাদের কেমন লাগলো তা অবশ্যই আমাদের জানাতে ভুলবেন না। বিনোদন জগত সম্পর্কিত সমস্ত ধরনের আপডেট পেতে চাইলে আমাদের অন্যান্য প্রতিবেদন গুলির উপর চোখ রাখতে থাকুন।

Back to top button